یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ حَقَّ تُقٰتِهٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ۪ وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِهٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡهَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمۡ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّکُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ
وَلۡتَکُنۡ مِّنۡکُمۡ اُمَّۃٌ یَّدۡعُوۡنَ اِلَی الۡخَیۡرِ وَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ
وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ تَفَرَّقُوۡا وَ اخۡتَلَفُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَهُمُ الۡبَیِّنٰتُ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
১০২. হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না
১০৩. আর তোমরা সকলে আল্লাহ্র রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমর তো অগ্নিগর্তের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পার।
১০৪. আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে(১); আর তারাই সফলকাম।
১০৫. তোমরা তাদের মত হয়ে না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে(১) ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
তাফসীর
১০২নং আয়াতের তাফসীর
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ حَقَّ تُقٰتِهٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ
হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না
এখানে ইমানদারকে আল্লাহ ডাক দিয়েছে, এখন ইমানদার কারা?
একটি সহী হাদিস থেকে জানা যাক ইমানদার সম্পর্কে যা উল্লেখ রয়েছে-
সহি মুসলিম শরীফ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নং-১ (যে হাদিসটিকে হাদিসে জিবরাইল বলে) হাদিসের শেষের দিকে বলা হয়েছে,
عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ قَالَ . قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنِ الإِيمَانِ . قَالَ “ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ “ . قَالَ صَدَقْتَ
উল্লেখিত হাদিসে ঈমানের রোকন বা মুল বিষয় বলা হচ্ছে ৬ টি,
১। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা
২। ফেরেস্তাদের প্রতি ঈমান আনা
৩। আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের উপর ঈমান আনা
৪। আল্লাহর রাসুলদের প্রতি ঈমান আনা
৫। পরকালের প্রতি ঈমান আনা
৬। তাকদিরের ভালো মন্দের প্রতি ঈমান আনা
উপরোক্ত ছয়টি বিষয়ে যে বিশ্বাস করে সেই ব্যক্তি ইমানদার। এই ইমানদার ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ ডাক দিয়েছে তাকে ভয় করার জন্য,
আল্লাহর তাকওয়া বা ভয় হলো তার পূর্ণ অনুসর করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ আনুগত্য করা এবং তার অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকার নামই হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন। তার অনুগত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা-
সুরা নেসার ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ
হে ঈমাদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার শাসক বা বিচারকদের
এর পর বলা হয়েছে- অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। এর দ্বারা বুঝা যায় প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও তার রাসুলের অনুগতই করতে হবে।
এছাড়া সুরা ইমরানের ৩২ নং আয়াতে বলা হয়েছে
قُلۡ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ الرَّسُوۡلَ ۚ فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَاِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الۡکٰفِرِیۡنَ
বলুন, ‘তোমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য কর। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পছন্দ করেন না
এছাড়াও সুরা নুরের ৫৪ নং আয়াত, সুরা নুরের ৫৬ নং আয়াত, সুরা নিসার ৮০ নং আয়াত ও সুরা মুহাম্মদের ৩৩ নং আয়াতের বলা হয়েছে
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ لَا تُبۡطِلُوۡۤا اَعۡمَالَکُمۡ
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, আর তোমরা তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করো না।
আয়াতের শেষে মুসলিম না হয়ে যেন কারও মৃত্যু না হয় সেটার উপর জোর দেয়া হয়েছে। দুনিয়াতে ঈমানদারের অবস্থান হবে আশা-নিরাশার মধ্যে। সে একদিকে আল্লাহর রহমতের কথা স্মরণ করে নাজাতের আশা করবে, অপরদিকে আল্লাহর শাস্তির কথা স্মরণ করে জাহান্নামে যাওয়ার ভয় করবে।
কোন কোন তাফসীরকারক বলেছেন, সুরা ইমরানের ১০২ নং আয়াত নাযিল হলে সাহাবাগণ বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েন। তাই মহান আল্লাহ সুরা তাগাবুন আয়াত ১৬ নাযিল করে বলেছেন
فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسۡتَطَعۡتُمۡ
তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর।
এর পর আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন
وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ
তোমারা মুসলমান না হয়ে মৃত্যু বরন করোনা।
আমাদেরকে অবশ্যই মৃত্যু বরন করতে হবে, মৃত্যু থেকে কেউ বাচতে পারবে না
আল্লাহ তায়ালা সকল প্রাণীর মৃত্যু নির্ধারণ করে রেখেছেন। তিনি বলেন,
کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ
” প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে”। (সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৮৫)।
মৃত্যু থেকে কেউ পালিয়ে বাচতে পারবে না। বিভিন্ন যুগের জালেমরা যেমন মৃত্যু থেকে বাচতে পারেনি, এই যুগের জালেমরাও মৃত্যু থেকে বাচতে পারবেনা।
কোরআন মজিদে বলা হয়েছে-(সুরা জুমআ-৮)।
قُلۡ اِنَّ الۡمَوۡتَ الَّذِیۡ تَفِرُّوۡنَ مِنۡهُ فَاِنَّهٗ مُلٰقِیۡکُمۡ
হে নবী, আপনি বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করতে চাও, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের কাছে পৌঁছবে।
তারা যতই ক্ষমতা প্রয়োগ করুক অবশ্যই তাদেরকে আল্লাহ কাছে ফিরে যেতে হবে। আমরা সবাই আল্লাহর কাছে ফিরে যাবো।
আল্লাহ তাআলা বলেন, [সূরা সজদা: ১১]
قُلۡ یَتَوَفّٰىکُمۡ مَّلَکُ الۡمَوۡتِ الَّذِیۡ وُکِّلَ بِکُمۡ ثُمَّ اِلٰی رَبِّکُمۡ تُرۡجَعُوۡنَ
“বলুন, তোমাদের প্রাণ হরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ‘মালাকুল মওত’ তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।”
কিন্তু মৃত্যুর সময় তাকে আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা নিয়েই মরতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন আল্লাহ সম্পর্কে সু ধারণা না নিয়ে মারা না যায়।” [মুসলিম: ২৮৭৭]
আমাদেরকে অবশ্যই মৃত্যু বরন করতে হবে তাই আমরা মুসলিম হতে হবে, এখন প্রশ্ন হতে পারে মুসলিম কারা?
মুসলিম শব্দটি সালাম শব্দ থেকে উৎপত্তি যার শাব্দিক অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা। মুসলিম শব্দের অর্থ আত্নসর্মপনকারী।
পারিভাষিক অর্থেঃ
যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে মহান প্রতিপালক হিসেবে গ্রহন করবে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবেনা এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে নিজের জীবন চালাবে, হালাল কে হালাল বলে মানবে এবং হারামকে বয়কট করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রোজা রাখবে, নিসাবের অধিকারী হলে যাকাত আদায় করবে এবং হজ্জে গমন করবে। এইসব গুনাবলীর অধিকারী হলে তাকে মুসলিম বলা হয়।
আমরা পূর্ন ইসলাম পালন করলে মুসলিম হতে পারবো, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- সুরা মায়েদা আয়াত নং -০৩
اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম
ইসলামের আংশিক বিধান মেনে চললে আমরা মুসলিম হতে পারবো না, পুরোপুরি ইসলামের বিধান মেনে চললে মুসলিম হিসাবে গন্য করা হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন সুরা ইমরান আয়াত নং ১৯
اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰهِ الۡاِسۡلَامُ
নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন
১০৩নং আয়াতের তাফসীর
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا
আল্লাহকে ভয় করার কথা বলার পর ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধর’এর আদেশ দিয়ে এ কথা পরিষ্কার করে দিলেন যে, মুক্তিও রয়েছে এই দুই মূল নীতির মধ্যে এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে ও থাকতে পারে এই মূল নীতিরই ভিত্তিতে। এখন প্রশ্ন হতে পারে আল্লাহর রজ্জু বা রশি বলতে কি বুঝানো হয়েছে? এটি তাফসিরে ইবনে কাসিরের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর রজ্জু বলতে পবিত্র কোরআনকে বুঝানো হয়েছে। আবার আল্লামা সুয়ূতী (রহ.) বলেন, আল্লাহর রজ্জু দ্বারা দীন-ইসলামকে বুঝানো হয়েছে।
وَلاَ تَفَرَقُّوا ‘‘পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’’ এর মাধ্যমে দলে দলে বিভক্ত হওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, উল্লিখিত দু’টি মূল নীতি থেকে যদি তোমরা বিচ্যুত হয়ে পড়, তাহলে তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে তোমরা বিভক্ত হয়ে যাবে। বলাই বাহুল্য যে, বর্তমানে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনেই রয়েছে। কুরআন ও হাদীস বোঝার এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে পারস্পরিক কিছু মতপার্থক্য থাকলেও তা কিন্তু দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ নয়। এ ধরনের বিরোধ তো সাহাবী ও তাবেঈনদের যুগেও ছিল, কিন্তু তাঁরা ফির্কাবন্দী সৃষ্টি করেননি এবং দলে দলে বিভক্ত হয়েও যাননি। কারণ, তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সকলের আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র ছিল একটাই। আর তা হল, কুরআন এবং হাদীসে রসূল (সাঃ)। কিন্তু যখন ব্যক্তিত্বের নামে চিন্তা ও গবেষণা কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল, তখন আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র পরিবর্তন হয়ে গেল। আপন আপন ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের উক্তি ও মন্তব্যসমূহ প্রথম স্থান দখল করল এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উক্তিসমূহ দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হল। আর এখান থেকেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হল; যা দিনে দিনে বাড়তেই লাগল এবং বড় শক্তভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেল।
এখানে আল্লাহ তাআলা একটি মৌলিক থিওরি বলে দিয়েছেন। তা হলো, আল্লাহর রজ্জু অর্থাৎ কোরআন বা ইসলাম সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো; পরস্পর বিছিন্ন হয়ো না। সুতরাং আমরা মুসলিম—এই হিসেবে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব। এ ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লোক থাকবে, কালো-সাদা, এবং বিভিন্ন মতের মানুষও থাকবে। আল্লাহ সব জেনেই ঘোষণা দিয়েছেন যে মুসলিম হিসেবে এক হও। আর সব বাদ দিয়ে যদি মুসলিম হিসেবে এক হই তাহলে সফলতা হলো, সব বিপদ, বহিরাগত আক্রমণ মোকাবেলা করা সহজ হবে। যখন মুসলিমরা নিজের দেশ নিয়ে, নিজের গোত্র ও জাতি নিয়ে, নিজের মত নিয়ে বিভেদের রাস্তা তৈরি করতে শুরু করেছে, তখন থেকে মুসলিম বিশ্ব রাজত্ব হারাতে শুরু করেছে। যখন ছোট ছোট মত ও কথার কারণে নিজেরা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে, তখন থেকে জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়নে নিপতিত হয়েছে। আমাদের বৃহৎ পরিসরে ঐক্য প্রয়োজন।
আল্লাহ তায়ালা সুরা হুজরাতের ১০ নং আয়াতে বলেছেন
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ
মুমিনগণ তো পরস্পর ভাই ভাই
সুরা আন’আমের ১৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে
اِنَّ الَّذِیۡنَ فَرَّقُوۡا دِیۡنَهُمۡ وَ کَانُوۡا شِیَعًا لَّسۡتَ مِنۡهُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ
নিশ্চয় যারা তাদের দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন দায়িত্ব আপনার নয়
বনী-ইসরাঈলরা ৭২ টি দলে বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মতে ৭৩ টি দল সৃষ্টি হবে। তন্মধ্যে একদল ছাড়া সবাই জাহান্নামে যাবে। সাহাবায়ে কেরাম আর্য করলেনঃ মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি? উত্তর হল, যে দল আমার ও আমার সাহাবীদের পথ অনুসরণ করবে, তারাই মুক্তি পাবে। [তিরমিযী তাহকীককৃত ২৬৪০, ২৬৪১]
তাই আমাদের বিভিন্ন দলে বিভাক্ত হওয়া উচিত নয়।
وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ عَلَیۡکُمۡ
তোমরা আল্লাহর নেয়ামত কে স্বরন করো
দুনিয়াতে দোষী-নির্দোষ সবাই আল্লাহর নেয়ামত ভোগ করে। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তার আলো-বাতাস সমানভাবে দান করেন। তিনি কারো প্রতি জুলুম করেন না। তবে আল্লাহ তার অনুগত বান্দাদের নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বলেছেন। যারা তারা নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে তাদের তিনি সেরা পুরস্কার দান করেন। আর তাহচ্ছে মহান রবের ক্ষমা। আর যারা তার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না তাদের পরিণতি হয় খুবই ভয়াবহ। মহান আল্লাহ কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন- সুরা ইবরাহিমের ০৭ নং আয়াতে
وَ اِذۡ تَاَذَّنَ رَبُّکُمۡ لَئِنۡ شَکَرۡتُمۡ لَاَزِیۡدَنَّکُمۡ وَ لَئِنۡ کَفَرۡتُمۡ اِنَّ عَذَابِیۡ لَشَدِیۡدٌ
আর স্মরণ করুন, যখন তোমাদের রব ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে আরো বেশী দেব আর অকৃতজ্ঞ হলে নিশ্চয় আমার শাস্তি তো কঠোর।
বনি ইসরাইল জাতির জন্য মহান আল্লাহ আসমান থেকে ‘মান্না ও সালওয়া’ দান করেছিলেন। যা ছিল আল্লাহর নেয়ামত। দীর্ঘ দিন খাওয়ার পর তারা এ খাবারে নিরানন্দ ও বিরক্ত প্রকাশ করে এবং অভ্যাস মোতাবেক খাবারের আবেদন করে। যা ছিল আল্লাহর শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতার পরিপন্থী।
এরপরই আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম হলো- ‘তোমরা যে খাবার চাও, সেটা নগরবাসীর খাদ্য। যা নগরে পাওয়া সম্ভব। যদি তোমাদের সে খাদ্যের একান্তই প্রয়োজন হয়, তবে তোমাদের সামনে যে নগর রয়েছে, সেখানে প্রবেশ কর। কিন্তু নগরীতে প্রবেশের সময় যে আদব রয়েছে তা রক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে সম্মান দেখিয়ে এই নগরীতে প্রবেশ করতে হবে। তবেই তোমাদের জন্য রয়েছে মহান রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা। যার ওয়াদা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।
এরপর নগরে প্রবেশ করে তোমরা পানাহারের ব্যবস্থা করে নেবে। অথচ এর আগে মহান আল্লাহ ‘মান্না ও সালওয়া’কে উত্তম খাবার হিসেবে নিয়মিত আসমান থেকে নাজিল করতেন। যেখানে ওই খাবার পেতে বনি ইসরাইলদের কোনো কষ্ট করতে হতো না।
পরে তাদের অকৃতজ্ঞতার কারণে, তাদের চাহিদা মোতাবেক খাবার চাওয়ার কারণে, নেয়ামতে ভরপুর আসমানি খাবারের সব ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়।
মহান আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করায় বনি ইসরাইল জাতি দীর্ঘ ৪০ বছর ময়দানে তীহ-এ দিকভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করেছিল। আল্লাহর অকৃতজ্ঞতার কারণে ময়দানে তীহ-এ অবস্থানকালে প্রায় ছয় লাখ লোক মরে পচে-গলে শেষ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র বিশ জনে।
এ অভিশাপ ও ধ্বংসযজ্ঞ ছিল শুধু আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়অ আদায় না করার কারণে।
আমাদের জীবনে যে নিয়ামত আল্লাহ দিয়েছেন তার শুকরিয়া কখনও আদায় করা সম্ভব নয় তাই যথাসাধ্য আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া হিসাবে আলহামদুল্লিহ বলা উচিত।
এর পর আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِهٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡهَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمۡ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّکُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ
তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমর তো অগ্নিগর্তের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পার।
১০৪নং আয়াতের তাফসীর
وَلۡتَکُنۡ مِّنۡکُمۡ اُمَّۃٌ یَّدۡعُوۡنَ اِلَی الۡخَیۡرِ وَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ
আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে(১); আর তারাই সফলকাম।
এই আয়াতের তাফসির নিম্মরুপঃ
যে সকল ফরজ ও নফল কাজের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পায় এবং নৈকট্য সাধিত হয় তাকে মারূফ বলে। আর মুনকার হচ্ছে মারূফের বিপরীত। এমন কথা ও কাজ যাকে শরিয়ত হারাম, অপছন্দ ও ঘৃণা করে হারাম সাব্যস্ত করেছে।
উপরোক্ত সংজ্ঞা সামনে রাখলে আমরা দেখতে পাব যে শরিয়তের মৌলিক ও আনুষঙ্গিক সব বিষয় যেমন আক্বিদা-বিশ্বাস, ইবাদত, আখলাক-সুলুক ও মুআমালাত-ফরয হোক বা হারাম, মোস্তাহাব কিংবা মাকরূহ-সবই উভয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর মধ্যে যা ভাল ও কল্যাণকর তা মারূফের অন্তর্ভুক্ত আর যা খারাপ ও অকল্যাণকর মুনকারের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তাআলা আমর বিল মারূফ এবং নেহি আনিল মুনকারকে (সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ) মোমিন ও মুনাফেকদের সাথে পার্থক্যকারী নিদর্শন হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন।
সাহাবি আবু সাইদ খুদরী রা, থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি তোমাদের কেউ অন্যায় অশ্লীল কর্ম দেখলে শক্তি দ্বারা প্রতিহত করবে। যদি সমর্থ না হও তাহলে কথার দ্বারা প্রতিবাদ করবে এতেও সমর্থ না হলে মন থেকে ঘৃণা করবে। আর এটিই হচ্ছে সবচে দুর্বল ঈমান। আবূ দাউদ হাদিস নং-১১৪০
আল্লাহ তায়াল সুরা ইমরানের ১১০ নং আয়াতে বলেছেন-
کُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ
তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত(১), মানব জাতির জন্য যাদের বের করা হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে
আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের উপকারিতা:
সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানে অনেক ফায়দা ও উপকারিতা রয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নে প্রদত্ত হল।
(১) মন্দ ও অন্যায় দেখে তা প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার পদক্ষেপ না নেয়া শাস্তি যোগ্য অপরাধ। কোরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী এসেছে। সুতরাং আমার বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের মাধ্যমে আল্লাহর সে শাস্তি হতে দূরে থাকা যায় ও পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
(২) আল্লাহ তাআলা কল্যাণ ও নেক কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করার উৎসাহ-বরং নির্দেশ দিয়েছেন। আমর বিল মারূফ ও নেহি আনিল মুনকারের মাধ্যমে উক্ত নির্দেশের বাস্তবায়ন হয় এবং কল্যাণ ও নেকের কাজে সহযোগিতা হয়।
(৩) সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কারণ এর মাধ্যমে যাবতীয় অকল্যাণ ও অনিষ্ট বিদূরিত হয়। ফলে মানুষ স্বীয় দ্বীন-জান-সম্পদ ও সম্মানের ব্যাপারে নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বোধ করে।
(৪) এর মাধ্যমে অন্যায় ও অনিষ্টের হার হ্রাস পায়। সমাজ থেকে মন্দ ও অশ্লীল কাজের প্রতিযোগিতা প্রদর্শনী বিলুপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যেগুলো মূলত সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করত। ফলে সমাজ শান্তি শৃঙ্খলা, মিল-মহব্বত ও সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠে।
সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করতে গেলে বিপদ আসতে পারে তখন আমাদের ধর্য্য ধারন করতে হবে। লোকমান হাকিম তার সন্তানকে এই উপদেশ দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালার সে কথাগুলো পছন্দ হওয়ায় তিনি পবিত্র কুরআনে তা বর্ননা করেছেন, সুরা লোকমানের ১৭ নং আয়াত
یٰبُنَیَّ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ وَ اۡمُرۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ انۡهَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ اصۡبِرۡ عَلٰی مَاۤ اَصَابَکَ
হে আমার প্রিয় বৎস! সালাত কায়েম করো, সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ কর, আর তোমার উপর যা আপতিত হয় তাতে ধৈৰ্য ধারণ করা।
এখন প্রশ্ন হতে পরে কিভাবে আমরা সৎ কাজের নির্দেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবো?
তার উত্তর আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন সুরা নহলের ১২৫ নং আয়াতে-
اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡهُمۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ
আপনি মানুষকে দাওয়াত(১) দিন আপনার রবের পথে হিকমত(২) ও সদুপদেশ(৩) দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়
আর যারা সৎ কাজের নির্দেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করেছে তারা সফলকাম এবং তাদের পুরুস্কার হচ্ছে জান্নাত। আল্লাহ বলেছেন সুরা বাকারার ৮২ নং আয়াতে
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ
আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তারাই জান্নাতবাসী, তারা সেখানে স্থায়ী হবে
১০৫নং আয়াতের তাফসীর
وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ تَفَرَّقُوۡا وَ اخۡتَلَفُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَهُمُ الۡبَیِّنٰتُ ؕ
তোমরা তাদের মত হয়ে না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে(১) ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে।
এখানে পুর্ববর্তী নবীদের এমন সব উম্মাতের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে, যারা সত্য দীনের সরল ও সুস্পষ্ট শিক্ষা লাভ করেছিল৷ কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর দীনের মূল বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে দীনের সাথে সম্পর্কবিহীন গৌণ ও অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়াবলীর ভিত্তিতে নিজেদেরকে একটি আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে দিয়েছিল৷ তারপর অবান্তর ও আজেবাজে কথা নিয়ে এমনভাবে কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, আল্লাহ তাদের ওপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন তার কথাই তারা ভুলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাস ও নৈতিকতার যেসব মূলনীতির ওপর আসলে মানুষের সাফল্য ও কল্যাণের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, তার প্রতি কোন আগ্রহই তাদের ছিল না৷
সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর (বিভিন্ন দলে) বিভক্ত হয়েছে’ এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের পারস্পরিক বিরোধ ও দলাদলির কারণ এই ছিল না যে, তারা সত্য জানতো না এবং দলীলাদির ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল, বরং প্রকৃত ব্যাপার হল এই যে, তারা সব কিছু জানা সত্ত্বেও কেবল দুনিয়ার লোভে এবং ব্যক্তিস্বার্থ অর্জনের লক্ষ্যে বিরোধ ও দলাদলির পথ অবলম্বন করেছিল এবং এ পদ্ধতি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল। কুরআন মাজীদ বারংবার বিভিন্নভাবে (তাদের) প্রকৃত ব্যাপারকে তুলে ধরেছে এবং তা থেকে দূরে থাকার তাকীদও করেছে। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় যে, এই উম্মতের বিভেদ সৃষ্টিকারীরাও ঠিক ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের মতই স্বভাব অবলম্বন করেছে। তারাও সত্য এবং তার প্রকাশ্য দলীলাদি খুব ভালভাবেই জানে, তা সত্ত্বেও তারা দলাদলি ও ভাগাভাগির উপর শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধির সমস্ত মেধাকে বিগত জাতিদের মত (শরীয়তের) অপব্যাখ্যা এবং বিকৃতি করার জঘন্য কাজে নষ্ট করছে।
সুরা আন’আমের ১৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে
اِنَّ الَّذِیۡنَ فَرَّقُوۡا دِیۡنَهُمۡ وَ کَانُوۡا شِیَعًا لَّسۡتَ مِنۡهُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ
নিশ্চয় যারা তাদের দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন দায়িত্ব আপনার নয়
আরো বলা হয়েছে- সুরা মুমিনুন আয়াত ৫৩
فَتَقَطَّعُوۡۤا اَمۡرَهُمۡ بَیۡنَهُمۡ زُبُرًا ؕ کُلُّ حِزۡبٍۭ بِمَا لَدَیۡهِمۡ فَرِحُوۡنَ
কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে তাদের দ্বীনকে বহু ভাগে বিভক্ত করেছে; প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে, তা নিয়েই আনন্দিত
নিঃসন্দেহে এসব দলাদলি আল্লাহ্র নির্দেশের পরিপন্থী। এসব দলাদলির ফলাফলও কল্যাণকর নয়। কেননা প্রত্যেকটি দল অপর পক্ষকে নানাভাবে গালাগালি করে থাকে।
এরপরের অংশে আল্লাহ বলেছেন-
وَ اُولٰٓئِکَ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
আদের আবস্থান হবে জাহান্নামে, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, যা খুবই ভয়ানক জায়গা, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন সুরা বাকারার ৩৯ নং আয়াতে-
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ
আর যারা কুফরী করেছে এবং আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।
আলোচনা শেষ করার আগে কুরআনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাচ্ছি, সুরা আস সাজদা এর ২২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ ذُکِّرَ بِاٰیٰتِ رَبِّهٖ ثُمَّ اَعۡرَضَ عَنۡهَا
যে ব্যক্তি তার রবের আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশপ্ৰাপ্ত হয়ে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে?
وَ اٰخِرُ دَعۡوٰىهُمۡ اَنِ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ