Tuesday , December 3 2024

সুরা মুতাফফিফীন এর ১-৯ নং আয়াতের তাফসির

সুরা মুতাফফিফীন এর ১-৯ নং আয়াতের তাফসির

মুতাফফিফীন শব্দটির অর্থ ‘যারা ওজনে কম দেয়’।

নামকরণ :
সুরা মুতাফফিফীন‌ কোরআনের ৮৩তম সুরা। মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরাটির আয়াত ৩৬টি। সুরার প্রথম আয়াতের وَیۡلٌ لِّلۡمُطَفِّفِیۡنَ থেকে সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে। মুতাফফিফ অর্থ মাপে কম দেয় এমন ব্যক্তি, এর বহুবচন মুতাফফিফীন। সুরাটির শুরুতে আল্লাহ মাপে কম দিয়ে প্রতারণাকারীদের জন্য শাস্তি ঘোষণা করেছেন।

নাযিলের সময়কাল ও শানে নুযুল:
বিশুদ্ধতম মতে এই সুরার শেষাংশ মক্কায় নাযিল হয় এবং সুরার প্রথমাংশ মদিনায় নাযিল হয়। কিছু মুফাসসিরগন এই সূরাকে মদীনায় অবতীর্ণ বলেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় তশরীফ আনেন, তখন মদীনাবাসীদের সাধারণ কাজ করবার ‘কাইল’ তথা মাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হত। তারা এ ব্যাপারে চুরি করা ও কম মাপায় খুবই অভ্যস্ত ছিল। এর প্রেক্ষিতে সূরা আল-মুতাফফিফীন নাজিল হয়। এই সূরা নাজিল হওয়ার পর তারা এই বদ-আভ্যাস থেকে বিরত হয় এবং এমন বিরত হয় যে, আজ পর্যন্ত তাদের সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত।

অনুবাদ

وَیۡلٌ لِّلۡمُطَفِّفِیۡنَ ۙ ١ الَّذِیۡنَ اِذَا اکۡتَالُوۡا عَلَی النَّاسِ یَسۡتَوۡفُوۡنَ ۫ۖ ٢ وَاِذَا کَالُوۡ هُمۡ اَوۡ وَّزَنُوۡ هُمۡ یُخۡسِرُوۡنَ ؕ ٣ اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓئِکَ اَنَّہُمۡ مَّبۡعُوۡثُوۡنَ ۙ ٤ لِیَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ۙ ٥ یَّوۡمَ یَقُوۡمُ النَّاسُ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ؕ ٦ کَلَّاۤ اِنَّ کِتٰبَ الۡفُجَّارِ لَفِیۡ سِجِّیۡنٍ ؕ ٧ وَمَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا سِجِّیۡنٌ ؕ ٨ کِتٰبٌ مَّرۡقُوۡمٌ

১। বহু দুর্ভোগ আছে তাদের, যারা মাপে কম দেয়।  ২। যারা মানুষের নিকট থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয়।  ৩। আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়।  ৪। তারা কি চিন্তা করে না, তাদেরকে জীবিত করে ওঠানো হবে?  ৫। এক মহা দিবসে। ৬। যে দিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে। ৭। কখনই এটা সমীচীন নয়। নিশ্চয়ই পাপিষ্ঠদের আমলনামা আছে সিজ্জীনে। ৮। তুমি কি জান ‘সিজ্জীন’ (-এ রক্ষিত আমলনামা) কী? ৯। তা এক লিপিবদ্ধ দফতর। 

তাফসির

আয়াত নং-০১

وَیۡلٌ لِّلۡمُطَفِّفِیۡنَ ۙ

১। বহু দুর্ভোগ আছে তাদের, যারা মাপে কম দেয়।

تَطْفِيْفٌ এর অর্থ মাপে কম করা। যে এরূপ করে তাকে বলা হয় مُطَفَّف  কুরআনের এই আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসে মাপ ও ওজনে কম করাকে হারাম করা হয়েছে এবং সঠিকভাবে ওজন ও পরিমাপ করার জন্য কড়া তাগিদ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ সূরা আর-রহমান আয়াত ৯,  وَ اَقِیۡمُوا الۡوَزۡنَ بِالۡقِسۡطِ وَ لَا تُخۡسِرُوا الۡمِیۡزَانَ আর তোমরা ওজনের ন্যায্য মান প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওজনে কম দিও না।  শু’আইব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের ওপর এ অপরাধের কারণে আযাব নাযিল হয় যে, তাদের মধ্যে ওজনে ও মাপে কম দেওয়ার রোগ সাধারণভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং শু’আইব আলাইহিস সালাম এর বারবার নসীহত করা সত্বেও এ সম্প্রদায়টি এ অপরাধমূলক কাজটি থেকে বিরত থাকেনি।

আয়াত নং-০২

الَّذِیۡنَ اِذَا اكۡتَالُوۡا عَلَی النَّاسِ یَسۡتَوۡفُوۡنَ

অর্থঃ যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে

নেওয়া-দেওয়ার জন্য পৃথক পৃথক মাপার পাত্র রাখা এবং দাঁড়ি মেরে ওজনে কম করা হল বড় জঘন্য একটি চারিত্রিক ব্যাধি। যার পরিণাম দ্বীনে এবং আখেরাতে বরবাদী ছাড়া কিছু নয়। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, যে জাতিই মাপ ও ওজনে কম দেবে, সে জাতিই দুর্ভিক্ষ, কঠিন খাদ্য-সংকট এবং শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হবে। (ইবনে মাজাহ ৫০১৯নং, সিলসিলাহ সহীহাহ ১০৬নং)

আয়াত নং-০৩

وَ اِذَا كَالُوۡهُمۡ اَوۡ وَّزَنُوۡهُمۡ یُخۡسِرُوۡنَ

আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় তথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে রসূলুল্লাহ্ (সা) বলেনঃ خمس بخمس অর্থাৎ পাঁচটি গোনাহের শাস্তি পাঁচটি—১. যে ব্যক্তি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, আল্লাহ্ তার উপর শত্রুকে প্রবল ও জয়ী করে দেন। ২. যে জাতি আল্লাহর আইন পরিত্যাগ করে অন্যান্য আইন অনুযায়ী ফয়সালা করে, তাদের মধ্যে দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ৩. যে জাতির মধ্যে অগ্নীলতা ও ব্যভিচার ব্যাপক হয়ে যায়, আল্লাহ্ তাদের উপর প্লেগ ও অন্যান্য মহামারী চাপিয়ে দেন। ৪. যারা মাপ ও ওজনে কম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে দুর্ভিক্ষের সাজা দেন। ৫. যারা যাকাত আদায় করে না, আল্লাহ্ তাদেরকে বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করে দেন।

আয়াত নং-০৪

اَلَا یَظُنُّ اُولٰٓئِكَ اَنَّهُمۡ مَّبۡعُوۡثُوۡنَ

তারা কি বিশ্বাস করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে

সুরা আল ইমরান আয়াত -১৮৫

كُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ وَ اِنَّمَا تُوَفَّوۡنَ اُجُوۡرَكُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ

জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। কেবলমাত্র কেয়ামতের দিনই তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হবে।

সুরা মুমিনুন আয়াত-১৬

 ثُمَّ اِنَّكُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ تُبۡعَثُوۡنَ

তারপর কেয়ামতের দিন নিশ্চয় তোমাদেরকে উত্থিত করা হবে।

আয়াত নং-০৫

لِیَوۡمٍ عَظِیۡمٍ    মহাদিনে

আয়াত নং-০৬

یَّوۡمَ یَقُوۡمُ النَّاسُ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ   যেদিন দাঁড়াবে সমস্ত মানুষ সৃষ্টিকুলের রবের সামনে

যেদিন সমস্ত মানুষ সারা জাহানের প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হবে; যিনি সমস্ত গোপন কথা সম্পর্কে অবগত আছেন? অর্থ এই দাঁড়াল যে, এ কর্ম সেই লোকেরাই করে থাকে, যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় ও কিয়ামতের শঙ্কা নেই।  ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যেদিন সমস্ত মানুষ জগতসমূহের রবের সামনে দাঁড়াবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের কানের মধ্যভাগ পর্যন্ত ঘামে ডুবে থাকবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মানুষ তাদের স্বীয় আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। কারও ঘাম হবে গোড়ালি পর্যন্ত, কারও হবে হাঁটু পর্যন্ত। আবার কারও ঘাম হবে কোমর পর্যন্ত; কারও ঘাম মুখের লাগামের মত হবে। তারপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মুখের দিকে ইশারা করেন।

আয়াত নং-০৭

 كَلَّاۤ اِنَّ كِتٰبَ الۡفُجَّارِ لَفِیۡ سِجِّیۡنٍ ؕ   কখনো না, পাপাচারীদের আমলনামা তো সিজ্জীনে(১) আছে।

 سجين (সিজ্জীন): কেউ কেউ বলেন, এর উৎপত্তি سجن শব্দ থেকে; যার মানে জেলখানা। উদ্দেশ্য হল, জেলখানার মত একটি অতি সংকীর্ণ জায়গা। আর কেউ কেউ বলেন, এটি ভূগর্ভের সব থেকে নিচের অংশে একটি জায়গার নাম; যেখানে কাফের, অত্যাচারী এবং মুশরিকদের আত্মা এবং তাদের আমল-নামা জমা ও সংরক্ষিত থাকে। এই জন্য তাকে ‘লিপিবদ্ধ পুস্তক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

আয়াত নং-০৮

وَ مَاۤ اَدۡرٰىكَ مَا سِجِّیۡنٌ   আর কিসে আপনাকে জানাবে সিজ্জীন কী

আয়াত নং-০৯

 كِتٰبٌ مَّرۡقُوۡمٌ ؕ    ওটা হচ্ছে লিপিবদ্ধ পুস্তক

কাফের ও পাপাচারীদের আমলনামা মোহর লাগিয়ে সংরক্ষিত করা হবে। ফলে এতে হ্রাস-বৃদ্ধি ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকবে না। এই সংরক্ষণের স্থান হবে সিজ্জীন৷ এর প্রমাণ আমরা বারা ইবনে আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বৰ্ণিত হাদীসে দেখতে পাই। সেখানে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ্ কাফেরদের রূহ হরণ হওয়ার পর বলবেন, اكْتُبُوا كِتَابَهُ فِي سِجِّينٍ فِي الأَرْضِ السُّفْلَى “তার কিতাবকে সর্বনিম্ন যমীনে সিজ্জীনে লিখে রাখ”। [মুসনাদে আহমাদ ৪/২৮৭]

শিক্ষা

১। ওজনে কম দেওয়া হারাম ।

২। যারা ওজনে কম দেয় তাদের জন্য দূর্ভোগ।

৩। যারা ওজনে কম দেয় তারা কিয়ামতে তাদের রবের সামনে দাঁড়াবে।  

৪। পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জীনে থাকবে।

About Md Nazmul Azam

I am website developer.

Check Also

সুরা ফাতিহা আয়াত ২ এর তাফসীর

সুরা ফাতিহা আয়াত ২ ১:২ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ (২) সমস্ত প্রশংসা সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর …

বিসমিল্লাহ এর নাম ও ইতিহাস জানুন

১:১ بِسۡمِ اللّٰهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ ১. রহমান, রহীম আল্লাহর নামে। ১. সাধারণত আয়াতের অনুবাদে বলা হয়ে …

কুরআন তেলাওয়াত এর পূর্বে কি পড়তে হয়

কুরআন তেলাওয়াত এর পূর্বে পড়তে হয় أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ অর্থ: বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *