সুরা বালাদ
নামকরণ :
প্রথম আয়াতে ( আরবী الْبَلَدِ) এর আল বালাদ শব্দটি থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
নাযিলের সময় কাল :
এই সূরার বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভংগী মক্কা মু’আযয্মার প্রথম যুগের সূরাগুলোর মতোই । তবে এর মধ্যে একটি ইংগিত পাওয়া যায় , যা থেকে জানা যায় , এই সূরাটি ঠিক এমন এক সময় নাযল হয়েছিল যখন মক্কায় কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতায় উঠে পড়ে লেগেছিল এবং তাঁর ওপর সব রকমের জুলুম নিপীড়ন চালানো নিজেদের জন্য বৈধ করে নিয়েছিল।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য :
দুনিয়ায় মানুষের এবং মানুষের জন্য দুনিয়ার সঠিক অবস্থান , মর্যাদা ও ভুমিকা বুঝিয়ে দেয়া । মানুষকে একথা জানিয়ে দেয়া যে আল্লাহ মানুষের জন্য সৌভাগ্যের ও দুর্ভাগ্যের উভয় পথই খুলে রেখেছেন , সেগুলো দেখার ও সেগুলোর ওপর দিয়ে চলার যাবতীয় উপকরণও তাদেরকে সরবরাহ করেছেন। এবং মানুষ সৌভাগ্যের পথে চলে শুভ পরিণতি লাভ করবে অথবা দুর্ভাগ্যর পথে চলে অশুভ পরিণতির মুখোমুখি হবে , এটি তার নিজের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে।
প্রথমে মক্কা শহরকে , এর মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেসব বিপদের সম্মুখীন হতে হয় সেগুলোকে এবং সমগ্র মানব জাতির অবস্থাকে এই সত্যটির সপক্ষে এই মর্মে সাক্ষী হিসেবে পেশ করা হয়েছে যে , এই দুনিয়াটা মানুষের জন্য কোন আরাম আয়েশের জায়গা নয়। এখানে ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে আনন্দ উল্লাস করার জন্য তাকে পয়দা করা হয়নি। বরং এখানে কষ্টের মধ্যে তার জন্ম হয়েছে । দুনিয়ার এই কর্মচাঞ্চল্যে মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার কর্মতৎপরতা , প্রচেষ্টা , পরিশ্রম ও কষ্টসহিষ্ণতার ওপর।
এরপর মহান আল্লাহ বলছেন , আমি মানুষকে জ্ঞানের বিভিন্ন উপকরণ এবং চিন্তা ও উপলদ্ধির যোগ্যতা দিয়ে তার সামনে ভালো ও মন্দ দু’টো পথই উন্মুক্ত করে দিয়েছি। একটি পথ মানুষকে নৈতিক অধপাতে নিয়ে যায়। এ পথে চলার জন্য কোন কষ্ট স্বীকার করতে হয় না। বরং তার প্রবৃত্তি সাধ মিটিয়ে দুনিয়ার সম্পদ উপভোগ করতে থাকে । দ্বিতীয় পথটি মানুষকে নৈতিক উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। এটি একটি দুর্গম গিরিপথের মতো। এ পথে চলতে গেলে মানুষকে নিজের প্রবৃত্তি ওপর জোঁর খাটাতে হয়। কিন্তু নিজের দুর্বলতার কারণে মানুষ এই গিরিপথে ওঠার পরিবর্তে গভীর খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়াই বেশী পছন্দ করে।
১। لَاۤ اُقۡسِمُ بِهٰذَا الۡبَلَدِ
শপথ করছি এই (মক্কা) নগরের
বাক্যের শুরুতে لاَ ‘না’ বোধক নয়। বরং ‘অতিরিক্ত’ হিসাবে আনা হয়েছে তম্বীহ ও তাকীদের জন্য এবং প্রতিপক্ষের ভ্রান্ত ধারণা খন্ডন করার জন্য। অর্থাৎ তোমরা যা বলছ, তা ঠিক নয়। বরং আমি শপথ করে যা বলছি, সেটাই ঠিক। শপথের সাথে لاَ -এর ব্যবহার আরবী বাকরীতিতে খুবই প্রসিদ্ধ।
‘এই নগরী’ বলতে মক্কা নগরীকে বুঝানো হয়েছে।
২। وَ اَنۡتَ حِلٌّۢ بِهٰذَا الۡبَلَدِ
আর আপনি এ নগরের অধিবাসী
আমি এই মহান নগরীর শপথ করছি যার হুরমত ও উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে তুমি অবগত। সেই সাথে তুমি এখানকার বাসিন্দা হওয়ায় এর সম্মান আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। পূর্ববর্তী আয়াতের শপথকে অত্র আয়াতের সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদাকে আরও উন্নত করা হয়েছে। যেন তাঁর জন্যই শপথ করা হয়েছে। এর মধ্যে কুরায়েশ নেতাদের মূর্খতার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, তারা রাসূল (ছাঃ)-এর মহান মর্যাদাকে বুঝতে পারেনি। বরং তারা উল্টা তাঁকে বহিষ্কার করার ষড়যন্ত্র করছে। অথচ তিনিই এ নগরীতে বসবাসের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি এবং তাঁর মাধ্যমেই এ নগরীর মর্যাদা পূর্ণতা পেয়েছে
৩। وَ وَالِدٍ وَّ مَا وَلَدَ
শপথ জন্মদাতার ও যা সে জন্ম দিয়েছে
এখানে পিতা ও সন্তান বলতে আদম ও বনু আদমকে বুঝানো হতে পারে। যেমন প্রথমে সকল নগরীর উৎস বা উম্মুল ক্বোরা হিসাবে মক্কা নগরীর শপথ করা হয়েছে। তেমনি মানবজাতির উৎস বা আদি পিতা হিসাবে আদম (আঃ)-এর শপথ করা হয়েছে। অতঃপর বিগত ও অনাগত সকল আদম সন্তানের শপথ করা হয়েছে। অথবা সকল যুগের পিতা ও সন্তানদের শপথ করে বলা হচ্ছে-
৪। لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡ کَبَدٍ
নিঃসন্দেহে আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে
এটি পূর্বোক্ত আয়াতসমূহের জওয়াব। আল্লাহ তাঁর যেকোন সৃষ্টির শপথ করে থাকেন। আর এর দ্বারা উক্ত সৃষ্টির মর্যাদা বৃদ্ধি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। সূরার শুরুতে মক্কা নগরী, অতঃপর আদম ও বনু আদম বা পিতা ও সন্তানদের শপথ করে, অতঃপর لَ ও قَدْ সহ মোট তিনটি তাকীদ সহযোগে আল্লাহ বলছেন যে, আমরা অবশ্যই মানুষকে ক্লেশনির্ভর প্রাণীরূপে সৃষ্টি করেছি।
كَبَدٍ অর্থ نصب ومشقة ‘কষ্ট ও ক্লেশ’। মানুষ তার মায়ের গর্ভ থেকেই নানাবিধ কষ্ট ও রোগ-পীড়ার সম্মুখীন হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানারূপ বিপদাপদ ও কায়-ক্লেশের মধ্য দিয়ে তাকে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। যদিও দৈহিক কষ্ট-দুঃখ অন্য প্রাণীর জীবনেও হয়ে থাকে। তথাপি মানুষের বিষয়টি নির্দিষ্টভাবে বলার কারণ হ’ল সম্ভবতঃ এই যে, (১) মানুষ হ’ল সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি। যাকে কথা বলার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা দান করা হয়েছে। (২) মানুষ একমাত্র প্রাণী যাকে জ্ঞান সম্পদ দান করা হয়েছে। সেকারণ তাকে তার প্রতিটি কথা ও কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। (৩) মানুষের উপলব্ধি ও চেতনাবোধ অন্য সকল প্রাণীর চাইতে বেশী। তাছাড়া যার জ্ঞান ও বিবেকশক্তি যত প্রখর তার চেতনা ও দূরদৃষ্টি তত প্রখর। ফলে পরিশ্রমের কষ্ট চেতনাভেদে কম-বেশী হয়ে থাকে। (৪) মানুষকে তার সারা জীবনের কর্মের হিসাব ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকটে দিতে হয়। যা অন্য প্রাণীকে দিতে হয় না। (৫) মানুষের জন্য তার পার্থিব জীবনটা হ’ল পরীক্ষাগার। প্রতি পদে পদে তাকে পরীক্ষা দিয়ে চলতে হয়। তাই মানুষের স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে এবং তার দায়িত্ববোধকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যই এখানে মানুষকে মূল আলোচ্য বিষয় হিসাবে পেশ করা হয়েছে।
৫। اَیَحۡسَبُ اَنۡ لَّنۡ یَّقۡدِرَ عَلَیۡهِ اَحَدٌ
সে কি মনে করে যে, কখনো তার উপর কেউ ক্ষমতাবান হবে না
শক্তিগর্বে স্ফীত অহংকারী মানুষকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ ধমকের সুরে কথাগুলি বলেছেন। যেমন বিগত যুগে ‘আদ জাতি বলেছিল, مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً ‘কে আছে আমাদের চাইতে অধিক শক্তিশালী’? (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)। অর্থাৎ সেকি ভেবেছে তাকে দমন করার কেউ নেই? অথবা সেকি ভেবেছে ক্বিয়ামত হবে না এবং তার অত্যাচারের বদলা নেওয়া হবে না? কালবী বলেন, বনু জুমাহ (بنو جُمَح) গোত্রের আবুল আশাদ্দায়েন (ابو الأشدين) নামে খ্যাত জনৈক ব্যক্তি দৈহিকভাবে দারুণ শক্তিশালী ছিল। সে একাই দশজনের সমান শক্তি রাখতো। সে ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর ঘোরতর শত্রু। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, وكان من أشد رجال قريش ‘ঐ লোকটি ছিল কুরায়েশদের সেরা শক্তিশালী পুরুষদের অন্যতম’। এতদ্ব্যতীত আরও একজন শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর চাচাতো ভাই রুকানা বিন হাশেম বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব। وكان مثلا فى البأس والشدة ‘যিনি শক্তি ও কঠোরতায় দৃষ্টান্ত স্বরূপ ছিলেন’ (কুরতুবী)। অনেকে ধনশালী অলীদ বিন মুগীরাহ প্রমুখের নামও বলেছেন (তানতাভী)। যারা নিজেদের শক্তির বড়াই ও ক্ষমতার অহংকারে অন্ধ ছিল এবং রাসূল (ছাঃ)-কে বেতোয়াক্কা করত। এদের সম্পর্কে আয়াতটি নাযিল হ’লেও আয়াতের বক্তব্য সকল যুগের সকল শক্তি মদমত্ত অহংকারী মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
৬। یَقُوۡلُ اَهۡلَکۡتُ مَالًا لُّبَدًا
সে বলে, আমি প্রচুর অর্থ নিঃশেষ করেছি
لُبَداً অর্থ كثيرًا ‘বহু’। تَلَبَّدَ الشَّيْئُ অর্থ اجتمع ‘জমা হওয়া’। এখানে অর্থ, ‘যখন সে ব্যয় করে গর্ব, অহংকার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে’। এই ব্যয় ইহকাল ও পরকালে তার কোন কাজে আসে না। এটি স্রেফ অপচয় মাত্র। সেকারণ أَهْلَكْتُ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ ‘আমি ধ্বংস করেছি’। কেননা এই ব্যয় সম্পূর্ণটাই তার বৃথা গেছে। কারণ নিকৃষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যয় আল্লাহর নিকটে উৎকৃষ্ট দান হিসাবে গৃহীত হয় না।
৭। اَیَحۡسَبُ اَنۡ لَّمۡ یَرَهٗۤ اَحَدٌ
সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখেনি
ধনশালী অহংকারী ব্যক্তিটি কত সম্পদ ব্যয় করেছে এবং কি উদ্দেশ্যে ব্যয় করেছে, সে কি ভেবেছে যে কেউ তা দেখেনি? অবশ্যই তা আল্লাহ দেখেছেন। তিনি তার ভিতর-বাহির সব খবর জানেন এবং সবকিছুর হিসাব তিনি নেবেন। তিনি বলেন, لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُواْ مَا فِيْ أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوْهُ يُحَاسِبْكُم بِهِ اللهُ، فَيَغْفِرُ لِمَنْ يَّشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَّشَاءُ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর জন্য। তোমাদের মনের মধ্যে যা আছে, তা তোমরা প্রকাশ করো বা গোপন করো, তার হিসাব তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহ নিবেন। অতঃপর তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করবেন ও যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতাশালী’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)
৮। اَلَمۡ نَجۡعَلۡ لَّهٗ عَیۡنَیۡنِ
আমরা কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি দুচোখ
আল্লাহ এখানে মানুষকে দেওয়া তিনটি অত্যন্ত মূল্যবান নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, যা টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদের চাইতে বহু বহু গুণ মূল্যবান। আর তা হ’ল মানুষের ‘দু’টি চোখ’, যা দিয়ে সে দেখে ও সৌন্দর্য উপভোগ করে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আল্লাহর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৃষ্টিসমূহ সে পর্যবেক্ষণ করে। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে লক্ষ-কোটি মাইল দূরে লুক্কায়িত নক্ষত্ররাজি অবলোকন করে। সাগরগর্ভে লুক্কায়িত মণি-মুক্তা উত্তোলন করে। এভাবে সে তার দু’চোখের মাধ্যমে আকাশ ও পৃথিবীর অসংখ্য সৃষ্টিরাজি স্বচক্ষে দেখে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর সৃষ্টিকৌশল সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান লাভ করে ও সেখান থেকে কল্যাণ আহরণ করে।
‘জিহবার’ সাহায্যে সে কথা বলে, খাদ্যের স্বাদ আস্বাদন করে এবং দুই মাড়ির দাঁতের মাঝে খাদ্য ঠেলে দেয়। যাতে তা ভালোভাবে চিবিয়ে হযম করা সহজ হয়। সর্বক্ষণ সরস জিহবার সাহায্যে মানুষ তার মনের কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে। এছাড়া জিহবার লালা তার খাদ্য হযমে সাহায্য করে এবং চর্মের উপরের ক্ষত ও বিষ নাশ করে।
‘দু’টি ঠোট’ মানুষের মুখগহবরের দু’টি কপাট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যা তার পর্দা করে ও চেহারার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। যা মুখের ভিতরে খাদ্যের সঞ্চালন করে এবং শব্দ ও বর্ণের যথাযথ উচ্চারণে সাহায্য করে। যদি ঠোট বা জিহবা ক্ষণিকের জন্য অসাড় হয়ে যায়, তাহ’লে সে বুঝতে পারে এ দু’টির মূল্য কত বেশী!
উক্ত নে‘মতগুলি দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা পরীক্ষা করা যে, বান্দা এগুলিকে কল্যাণের পথে ব্যয় করে, না অকল্যাণের পথে ব্যয় করে। সে এগুলিকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে, না শয়তানের পথে পরিচালিত করে। এজন্যেই বলা হয়, একটা মানুষ পূর্ণ মুমিন হয় তখনই, যখন তার হাত-পা, চোখ-কান ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পূর্ণভাবে মুসলমান হয়।
৯। وَ لِسَانًا وَّ شَفَتَیۡنِ
আর জিহ্বা ও দুই ঠোঁট
১০। وَ هَدَیۡنٰهُ النَّجۡدَیۡنِ
আর আমরা তাকে দেখিয়েছি দুটি পথ
ভাল ও মন্দ দুটি পথের দিশাই আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাকে দিয়েছেন। শুধুমাত্ৰ বুদ্ধি ও চিন্তার শক্তি দান করে তাকে নিজের পথ নিজে খুঁজে নেবার জন্য ছেড়ে দেননি। বরং তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। তার সামনে ভালো ও মন্দ এবং নেকী ও গোনাহের দু’টি পথ সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তার মধ্য থেকে নিজ দায়িত্বে যে পথটি ইচ্ছা সে গ্রহণ করতে পারে।
১১। فَلَا اقۡتَحَمَ الۡعَقَبَۃَ
তবে সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি
عقبة বলা হয় পাহাড়ের মাঝে মাঝে রাস্তা বা গিরিপথকে। সাধারণতঃ এ পথ বড় দুস্তর, দুরতিক্রম্য ও সংকটময় হয়। এটি মানুষের সেই শ্রম ও কষ্টকে স্পষ্ট করে বুঝাবার জন্য একটি উদাহরণ; যা নেক কাজ করার পথে শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং মনের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে করতে হয়। যেমন পাহাড়ের ঐ পথে চড়া অত্যন্ত কঠিন, তেমনি তার নেক কাজ করাও বড় সুকঠিন।
১২। وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا الۡعَقَبَۃُ
আর কিসে আপনাকে জানাবে—বন্ধুর গিরিপথ কী
১৩। فَکُّ رَقَبَۃٍ
এটা হচ্ছেঃ দাসমুক্তি
এসব সৎকর্মের মধ্যে প্রথমে দাসমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এটা খুব বড় ইবাদত এবং একজন মানুষের জীবন সুসংহত করার নামান্তর। বিভিন্ন হাদীসে এর অনেক সওয়াবের উল্লেখ এসেছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে কেউ কোন দাসকে মুক্ত করবে সেটা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিপণ হিসেবে বিবেচিত হবে”।
১৪। اَوۡ اِطۡعٰمٌ فِیۡ یَوۡمٍ ذِیۡ مَسۡغَبَۃٍ
অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্যদান
দ্বিতীয় সৎকর্ম হচ্ছে ক্ষুধার্তকে অন্নদান। যে কাউকে অন্নদান করলে তা আরও বিরাট সওয়াবের কাজ হয়ে যায়। তাই বলা হয়েছে, বিশেষভাবে যদি আত্মীয় ইয়াতীমকে অন্নদান করা হয়, তবে তাতে দ্বিগুণ সওয়াব হয়।
১৫। یَّتِیۡمًا ذَا مَقۡرَبَۃٍ
ইয়াতীম আত্মীয়কে
এ ধরনের ইয়াতীমের হক সবচেয়ে বেশী। একদিকে সে ইয়াতীম, দ্বিতীয়ত সে তার নিকটাত্মীয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মিসকীনকে দান করা নিঃসন্দেহে একটি দান। কিন্তু আত্মীয়দের দান করা দুটি। দান ও আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা।
১৬। اَوۡ مِسۡکِیۡنًا ذَا مَتۡرَبَۃٍ
অথবা দারিদ্র-নিষ্পেষিত নিঃস্বকে
অর্থাৎ, যে দারিদ্রে্র কারণে মাটি বা ধূলার উপর পড়ে থাকে। তার নিজ ঘর-বাড়ি বলেও কিছু থাকে না। মোট কথা হল যে, কোন ক্রীতদাস স্বাধীন করা, কোন ক্ষুধার্ত আত্মীয় অনাথ কিংবা মিসকীনকে খাবার দান করা গিরিপথে চলার মত কঠিন কাজ। যার দ্বারা মানুষ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করতে পারে। অনাথের তত্ত্বাবধান করা এমনিতেই বিরাট পুণ্যের কাজ। কিন্তু যদি সে আত্মীয় হয়, তাহলে তার তত্ত্বাবধান করায় আছে দ্বিগুণ সওয়াব; এক সদকা করার সওয়াব এবং দুই আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার ও তার হক আদায় করার সওয়াব।
১৭। ثُمَّ کَانَ مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡمَرۡحَمَۃِ
তদুপরি সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যারা ঈমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে ধৈর্য ধারণের, আর পরস্পর উপদেশ দিয়েছে দয়া অনুগ্রহের
এ আয়াতে ঈমানের পর মুমিনের এই কর্তব্য ব্যক্ত করা হয়েছে যে, সে অপরাপর মুসলিম ভাইকে সবর ও অনুকম্পার উপদেশ দেবে। সবরের অর্থ নিজেকে মন্দ কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখা ও সৎকর্ম সম্পাদন করা। مَرْحَمَة এর অর্থ অপরের প্রতি দয়াদ্র হওয়া। অপরের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করে তাকে কষ্টদান ও যুলুম করা থেকে বিরত হওয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের উম্মতের মধ্যে এই রহম ও করুণাবৃত্তিটির মতো উন্নত নৈতিক বৃত্তিটিকেই সবচেয়ে বেশী প্রসারিত ও বিকশিত করতে চেয়েছেন। হাদীসে এসেছে,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” لاَ يَرْحَمُ اللَّهُ مَنْ لاَ يَرْحَمُ النَّاسَ
“যে মানুষের প্রতি রহমত করে না। আল্লাহ তার প্রতি রহমত করেন না”। [বুখারী: ৭৩৭৬]
১৮। اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡمَیۡمَنَۃِ
তারাই সৌভাগ্যশালী
উপরে বর্ণিত গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ ক্বিয়ামতের দিন সৌভাগ্যশালীদের জন্য নির্ধারিত ডান সারিতে স্থান পাবে। ক্বিয়ামতের দিন মানুষকে তিন সারিতে ভাগ করা হবে। একটি হবে অগ্রগামী দল, একটি হবে দক্ষিণ সারির দল এবং একটি হবে বাম সারির দল। প্রথম দু’টি দল জান্নাতী হবে এবং বাম সারির লোকেরা জাহান্নামী হবে (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭-১২)। জান্নাতীদের ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হবে এবং তাদের সহজ হিসাব নেওয়া হবে (বনু ইস্রাঈল ১৭/৭১ অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সুরা বাকারা -৮২
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে তারাই জান্নাতবাসী, তারা সেখানে স্থায়ী হবে
১৯। وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِنَا هُمۡ اَصۡحٰبُ الۡمَشۡـَٔمَۃِ
আর যারা আমাদের আয়াতসমূহে কুফরী করেছে, তারাই হতভাগ্য
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সুরা বাকারা -৩৯
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ আর যারা কুফরী করেছে এবং আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করেছে তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে
২০। عَلَیۡهِمۡ نَارٌ مُّؤۡصَدَۃٌ
তারা পরিবেষ্টিত হবে অবরুদ্ধ আগুনে
আগুন তাদেরকে চারদিক থেকে বেষ্টন করবে। কোনদিক দিয়ে তারা পালাবার পথ পাবে না। الوِصاد أو الإصاد অর্থ ‘বন্ধ’ أوصدتُ البابَ أى أغلقته ‘আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছি’ (কুরতুবী)। অতএব مُّؤْصَدَةٌ অর্থ نار مغلقة চারদিক দিয়ে বন্ধ বা পরিবেষ্টিত। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُّؤْصَدَةٌ، فِيْ عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ ‘প্রজ্বলিত অগ্নি তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে, উঁচু উঁচু স্তম্ভসমূহে’
শিক্ষাঃ
- আল্লাহ মানুষের জন্য সৌভাগ্যের ও দুর্ভাগ্যের উভয় পথই খুলে রেখেছেন, সেগুলো দেখার ও সেগুলোর ওপর দিয়ে চলার যাবতীয় উপকরণও তাদেরকে সরবরাহ করেছেন। এবং মানুষ সৌভাগ্যের পথে চলে শুভ পরিণতি লাভ করবে অথবা দুর্ভাগ্যর পথে চলে অশুভ পরিণতির মুখোমুখি হবে, এটি তার নিজের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে।
- অহংকারী মানুষ এমন চিন্তাভাবনা করে যে কেউ তার উপর ক্ষমতাবান হতে পারবে না, তাকে পরাজিত করতে পারবে না। মূলত সে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তাই ভবিষ্যত সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ভাব পোষন করে। অহংকারীরা নিজেদেরকে সর্বময় ক্ষমতাধর মনে করে থাকে।
- ক্ষমতার অহংকারের পাশাপাশি কিছু মানুষ অর্থের দাপট ও দেখাতে থাকে।
- মানুষের যোগ্যতা বিকাশে সহায়ক এমন ৩ প্রকার অঙ্গের কথা স্মরন করিয়ে দিচ্ছেন। ২ টি চোখ, ১ টি জিহবা ও ঐ জিহবাকে সংযত রাখার জন্য ২ টি ঠোট (যা দিয়ে মানুষ অহঙ্গকার প্রকাশ করে) দিয়ে মানুষ অনেক কঠিন কাজ করতে পারে, কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারে।
- আল্লাহ মানবজাতিকে অন্য প্রানীদের থেকে শ্রেষ্ঠত্য দিয়ে দুটি কঠিন পথ দেখান। ভালো ও খারাপ দুটি পথেই কঠিন পরিশ্রম করে এগুতে হয় এবং সেই পথে চলার ক্ষেত্রে বাধা না দিয়ে চলতে দেন। মানুষ ভালো পথে চললেও আল্লাহ তাকে স্বাধীনভাবে চলতে দেন, খারাপ পথে চললেও।
- ডান সারির লোকদের বৈশিষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে-
- খাদ্যদান করে (এখানে লক্ষনীয় বিষয় যে, বলা হচ্ছে- সেই খাওয়ানোটা হয় খুবই কঠিন দূর্ভিক্ষ এর সময়ে। অর্থাৎ সুখ সাচ্ছন্দ্যের সময়ে তো বটেই এমনকি বিপদের সময়েও তারা অন্যের প্রতি খেয়াল রাখে, সাহায্য করে।)
- অসহায় সম্প্রদায় ইয়াতীমদেরকে সাহায্য করা
- ধুলিমলিন মিসকীনদেরকে সাহায্য করা
- ঈমানদার হওয়া
- পরস্পরকে ছবরের উপদেশ দেয়া
- পরস্পরের প্রতি দয়ার উপদেশ দেয়া
- পরস্পরকে ছবরের উপদেশ দেয়া ও দয়ার উপদেশ দেয়া এই কাজগুলো একাকী করা সম্ভব নয়। ১৭ তম আয়াতে বোঝানো হয়েছে ঈমান আনার পর ঈমানদাররা একাকী থাকার পরিবর্তে একটি দলে পরিনত হয়।
- যারা আল্লাহ্র আয়াত অস্বীকার করে তারা বাম সারির লোক তাদের জন্য রয়েছে পরিবেষ্টিত অগ্নি।